ইখলাস : ধর্মীয় অনুশীলনের প্রকৃত সৌন্দর্য -আলী আহমাদ মাবরুর
ইখলাস সকল আমলের গ্রহণযোগ্যতার প্রথম শর্ত। ইখলাস-বিহীন কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে কবুলযোগ্য নয়। পার্থিব মোহ ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের যাবতীয় লোভ থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর নিকট সমর্পণ করা জরুরি। ইখলাস থাকলে ছোটখাটো অনেক আমলও অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। আমাদের চারপাশে প্রদর্শনেচ্ছা যেভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, আমলের ক্ষেত্রে ইখলাসের অনুপস্থিতিও যেন সে আনুপাতিক হারেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, প্রথম যে তিনজন মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে- তারা হবে ঈমানদার এবং যারা নিজেদের নেক আমলের জন্য সুপরিচিত। এর মধ্যে প্রথমজন কুরআনের একজন ওস্তাদ- যিনি কুরআন শিখেছেন এবং অপরকে শিখিয়েছেন। দ্বিতীয়জন হবেন একজন মানবহিতৈষী ব্যক্তি, যিনি তার অগণিত সম্পদ মানুষের মাঝে দান-সাদাকা করেছেন। আর তৃতীয়জন হলো সে শহীদ যিনি খোদার পথে জিহাদ করেছেন। তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে কারণ বাহ্যত তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এসব কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে খ্যাতি ও মানুষের কাছে প্রশংসা ও স্বীকৃতি পাওয়ার লোভেই তারা এমনটা করেছেন। (মুসলিম হা/১৯০৫ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৩; মিশকাত-আলবানী হা/২০৫, ‘ইলম’ অধ্যায়)
ইমাম আল গাজ্জালি (রহ.) বলেন, “যদি তোমরা নিশ্চিত হতে চাও যে, তোমরা যা করেছো তা পুরোপুরিভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়েছে তাহলে তোমরা নিজেদের ওপর একটি পরীক্ষা চালাবে। খেয়াল করে দেখবে, কাউকে সাহায্য করার পর তোমাদের কেমন অনুভূতি হয়? নিজেদেরকে কি তোমার ঐ নেককার বান্দাদের মতো মনে হয় যারা অপরকে সাহায্য করে? কিংবা তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার পরও উপকারভোগীরা যখন তোমাদের প্রশংসা করে না, তখন কি তোমাদের রাগ হয়? যদি উপরোক্ত কোনো অনুভূতি তোমাদের মনে জাগ্রত হয় তাহলে বুঝবে যে, তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজটি করোনি। আর কিছু না হোক, অন্তত উপকারভোগীদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার একটি খায়েস থেকেই তোমরা কাজটি করেছো- এটাও তাহলে প্রমাণ হয়ে যায়।”
আমলের ভিত্তিই যেহেতু ইখলাস, তাই এ ভিত্তির গাঁথুনিতে দুর্বলতা থাকলে এর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা ভবনটাই যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ইখলাস কি বিশেষ কিছু ইবাদতের ক্ষেত্রেই ধারণ করা জরুরি নাকি যাপিত জীবনের অন্য সব কাজেও ইখলাসের অনুশীলনের অবকাশ আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হয় আল কুরআনের সে পরিচিত আয়াতের কথা যেখানে আল্লাহ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন, “আপনি বলুন: নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ সবকিছুই একমাত্র বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” (সূরা আনআম : ১৬২)
এ আয়াতের মধ্য দিয়ে বোঝাই যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নয়, বরং জীবনের সকল কার্যক্রমই শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তেই করতে হবে। এ বিষয়ে খুররম মুরাদ (রহ.) আরো বলেন, মানুষ সবসময় জীবনের কার্যক্রমগুলোকে নানাভাগে ভাগ করার চেষ্টা করে। তারা কিছু কাজকে পার্থিব আবার কিছু কাজকে ধর্মীয় হিসেবে গণ্য করে। মানুষ আরো মনে করে যে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কাজগুলোকেই আল্লাহর জন্য করতে হয়। আর অন্য কাজগুলোর জন্য তারা অন্য কিছু হিসেব করে।”
অথচ জীবন ধারণের জন্য আমরা হরহামেশাই যে কাজগুলো করছি, এগুলোকেও আমরা নিয়তের বরকতে রীতিমতো ইবাদতে পরিণত করতে পারি। আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন না হওয়ায় প্রায়শই লোকসানের পথেই যেন হাঁটছি। শুধুমাত্র যথাযথ নিয়ত করার মাধ্যমে আমরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদতে রূপান্তর করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন মুমিন বান্দা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য হালাল উপার্জন করার নিয়তে কর্মস্থলে যায়, তখন এ বিষয়গুলোও ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়ে যায়। বাহ্যত, তিনি হয়তো তার পাশের সহকর্মীর মতোই চাকরি বা ব্যবসা করছেন, কিন্তু নিয়তের কারণে তাদের দু’জনের কাজ পুরোই ভিন্ন হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে তিনি উত্তম পুরস্কারও লাভ করবেন। আমরা মূলত ছোট ছোট প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের মাধ্যমেও অনেক বড়ো উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করে নিতে পারি। নিজেদেরকেও উন্নত অবস্থানে নিয়ে আসীন করাতে পারি।
ইখলাসের গুরুত্ব
যদি আমরা হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনাবলি পর্যালোচনা করি, তাহলে বুঝবো, কেবলমাত্র ইখলাস থাকার কারণেই আল্লাহ তাকে হেফাজত করেছেন। একবার নয়, বারবার। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই সে মহিলা তার বিষয়ে চিন্তা করেছিল এবং সেও মহিলার বিষয়ে আগ্রহ বোধ করতো যদি না সে নিজের পালনকর্তার মহিমা অবলোকন করত। বিষয়টা এমনভাবে হয়েছে, যাতে আমি তার কাছ থেকে মন্দ বিষয় ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মুখলেস (মনোনীত বান্দাদের) একজন।” (সূরা ইউসুফ : ২৪)
সুবহান আল্লাহ। তাছাড়া শয়তান সবাইকেই ওয়াস ওয়াসা দিয়ে বিপথগামী করতে পারে। শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই শয়তান ব্যর্থ হয় যাদের অন্তরে ইখলাসের প্রকটতা থাকে। আল্লাহ বলেন, “শয়তান বলল: হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে বিচ্যুত করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব। শুধুমাত্র আপনার মনোনীত মুখলিসিনদের ক্ষেত্রেই আমি ব্যর্থ হবো।” (সূরা হিজর : ৩৯-৪০)
এ প্রসঙ্গে আমরা হযরত উমর রা.-এর বিষয়ে নবীজি সা.-এর মূল্যায়নের কথাও স্মরণ করতে পারি। রাসূল সা. বলেছিলেন, ‘উমর যে পথ দিয়ে যায় শয়তান ভয়েই সে পথ এড়িয়ে যায়।’ চিন্তা করুন, একটি মানুষের মধ্যে ইখলাস কতটা শক্তিশালী অবস্থায় থাকলে শয়তানও তার সামনে যেতেও ভয় পায়। আমরা এখনকার সময়ে এসে এমন কিছু যেন কল্পনাও করতে পারি না। কারণ স্বীকার করি বা না করি, উল্টো আমরাই এখন শয়তানের সামনে পদে পদে পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়ে যাই।
ইখলাস যত সমৃদ্ধ হবে, মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তি ততটাই উন্নত হয়ে উঠবে। মানুষ আমরা। আমরা সহজাতভাবেই ভুল করি। আমাদের কাজের উদ্দেশ্য ও নিয়ত নিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেরাই সংশয়ে পড়ে যাই। অনেক সময় কাজের নেপথ্যে খুব স্পষ্টভাবে নিয়তটাকেও শনাক্ত করা যায় না। এ কারণেই প্রতি মুহূর্তে আমাদের তৎপর ও একনিষ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাতে হবে। যত বেশি আমরা স্মরণ করবো যে, সকল কাজ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে, তত বেশি আমাদের কাজগুলো সুনিপুণ হয়ে উঠবে আর আল্লাহ পাকও আমাদেরকে বরকতে ও নেয়ামতে সিক্ত করে দেবেন।
ইখলাসের তিনটি বৈশিষ্ট্য:
আল্লাহ শুধুমাত্র সে সব ইবাদতকারীর মনেই ইখলাস প্রবেশ করিয়ে দেন যারা আন্তরিকভাবে ইখলাস অর্জন করতে চায়। শায়খ ওমর আব্দুল কাফি (রহ.) ইখলাসের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন : যার ভেতর ইখলাস আছে, তিনি কখনো তাকে নিয়ে পড়ে থাকেন না। কেননা, ‘আমার ইখলাস আছে’- এই বোধটি তাকে অহঙ্কারী বানিয়ে ফেলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, যদি আমরা একান্তে রাতের আঁধারে নামাজ পড়ি, কেউ আমাকে দেখলো না। নামাজের পর যদি আমরা ভাবি, আমার মধ্যেই ইখলাস আছে, কারণ আমি কাউকে দেখিয়ে নয় বরং আল্লাহর জন্যই একান্তে নামাজটি পড়লাম, তাহলে এ অনুভূতিগুলো কালক্রমে আমাদেরকে অহঙ্কার ও আত্মতৃপ্তির ফাঁদে ফেলে দিতে পারে।