দারসুল কুরআন
-সুরা আল ইনশিকাকঃ ১-২৫
(মক্কায় অবতীর্ণ)
-প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আাল্লাহর নামে (শুরু করছি)
(তেলাওয়াত মূল কুরআন মাজীদ থেকে দেখে নিন)
১. যখন আকাশ ফেটে যাবে
২. এবং নিজের রবের হুুকুম পালন করবে। আর (নিজের রবের হুকুম মেনে চলা) এটিই তার জন্য সত্য
৩. আর পৃথিবীকে যখন ছড়িয়ে দেয়া হবে।
৪. যা কিছু তার মধ্যে আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে সে খালি হয়ে যাবে
৫. এবং নিজের রবের হুকুম পালন করবে। আর ( নিজের রবের হুকুম মেনে চলা) এটিই তার জন্য সত্য
৬. হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো। পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।
৭. তারপার যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে,
৮. তার কাছ থেকে হালকা হিসাব নেয়া হবে
৯. এবং সে হাসিমুখে নিজের লোকজনের কাছে ফিরে যাবে।
১০. আর যার আমলনামা তার পেছন দিকে থেকে দেয়া হবে,
১১, সে মৃত্যুকে ডাকবে
১২. এবং জ্বলন্ত আগুনে গিয়ে পড়বে।
১৩. সে নিজের পরিবারের লোকদের মধ্যে ডুবে ছিল
১৪. সে মনে করেছিল, তাকে কখনো ফিরতে হবে না।
১৫. না ফিরে সে পারতো কেমন করে? তার রব তার কার্যকলাপ দেখছিলেন
১৬. কাজেই না, আমি কসম খাচ্ছি, আকাশের লাল আভার
১৭. ও রাতের এবং তাতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার,
১৮. আর চাঁদের, যখন তা পূর্ণরূপে লাভ করে
১৯. তোমাদের অবশ্যই স্তরে স্তরে এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
২০. তাহলে এদের কী হয়েছে, এরা ঈমান আনে না
২১. এবং এদের সামনে কুরআন পড়া হলে এরা সিজদাহ করে না?
২২. বরং এ অস্বীকারকারীরা উল্টো মিথ্যা আরোপ করে।
২৩. অথচ এরা নিজেদের আমলনামায় যা কিছু জমা করছে আল্লাহ তা খুব ভালো করেই জানেন।
২৪. কাজেই এদের যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও
২৫. তবে যারা ঈমান এনেছে এবং নেককাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।
নামকরণঃ
সূরার শুরুতে ইনশাক্কাত শব্দটি থেকে ইনশিকাক নামকরণ করা হয়েছে যা অর্থ ফেটে যাওয়া।
নাযিলের সময়কালঃ
মক্কায় একবার প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাসমূহের এটা একটি। তখনও তেমন নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয়নি। রাসূল (সাঃ) কিয়ামত ঘটন এবং আখিরাতে জবাবদিহিতার কথা মক্কাবাসীদেরকে জানাচ্ছিলেন যা তারা অস্বীকার করে যাচ্ছিল।
বিষয়বস্তুঃ
রাসূল (সাঃ) এর দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু ছিল তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত। মক্কার লোকদের কিয়ামত সংঘটন ও আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে ভীষণ আপত্তি ছিল। বর্তমান যুগেও তাই, কাণ আখেরাতে জবাবদিহিতা ও জান্নাত-জাহান্নামের কথা বিশ্বাস করলে আর আল্লাহর নাফরমানি এবং সমাজে যুলুম-নির্যাতন চালানো ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া কখনই সম্ভব হয় না। আর আল্লাহও ছোট্ট ছোট্ট সূরায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাষায় কিয়ামত সংঘটন ও আখেরাতে হিসাবদানের কথা ও এর পক্ষে যুক্তি বারবার উপস্থাপন করেছেন। ১-৫ আয়াত কিয়ামত সংঘটন এবং এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছেন আকাশ ও পৃথিবী তাঁরই সৃষ্টি এবং তারা তাদের রবের হুকুমই পালন করবে।
৬-১৯ আয়াত পর্যন্ত মানুষ ক্রমাগতভাবে তাঁর রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আল্লাহর কাছে হিসাবদানের জন্য তাকে উপস্থিত হতে হবে, সেই কথা উল্লেখ করতে যেয়ে মানুষের দুনিয়ার কর্মজীবন থেকে পর্যায়ক্রমে মৃত্যু, কবরের জীবন এবং সেখান থেকে উত্থান ও আল্লাহর আদালতে উপস্থিত হওয়া তেমনি, যেমন সূর্য ডুবে যাবার পর পশ্চিমাকাশে লাল আভা দেখা দেয়া, দিনের পরে রাতের আগমন; আবার একফালি চাঁদের ক্রমান্বয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মানুসারে মানুসও ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক আল্লাহর কাছেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষে কুরআনের বাণী অস্বীকারকারী কাফিরদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং ঈমান এনে নেত আমলকারীদের অগণিত পুরস্কার ও উত্তম প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে।
ব্যাখ্যাঃ
বর্তমান বিশ্ব যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে তা আল্লাহরই সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা এবং একদিন তিনি নিজেই তা ভেঙ্গে দেবেন। বিভিন্ন সূরায় কিয়ামত সংঘটনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে আকাশ ফেটে যাবে এবং যমীনের উঁচু-নিচু থাকবে না অর্থাৎ সাগর ও পাহাড়-পর্বত সব একাকার হয়ে এক সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। হাদীসের ভাষায় বলা হয়েছে, একটি দস্তরখানা বিছানোর মত হবে এবং মানুষ কেবল পা ফেলার মত জায়গা পাবে। মাটির গর্ভে যা কিছু রয়েছে অর্থাৎ সকল মানুষ তাদের আমল সাথে নিয়ে উত্থিত হবে। এর পিছনে একটিই যুক্তি, আর তা হলো আল্লাহর হুকুম। মানুষ ছাড়া আল্লাহর সকল সৃষ্টি তাঁর হুকুম মানতে বাধ্য।
কিয়ামত সংঘটনের পরে সকল মানুষ একত্রিত হওয়ার পরে তারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে সে উৎফুল্ল হয়ে পড়বে এবং খুশির সাথে তার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেয়ে তার আমলনামা দেখাবে; বোঝা যায় তার প্রিয়জনরাও ডান হাতে আমলনামা পেয়েছে। যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তাদের হিসাব হালকাভাবে নেয়া হবে অর্থাৎ তাদের ক্রটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করা হবে ও ক্ষমা করা হবে।
পক্ষান্তরে কাফির-মুশরিক ও আল্লাহর নাফরমানরা জনসমক্ষে হাত বাড়িয়ে আমলনামা গ্রহণে লজ্জাবোধ করায় তাদের আমলনামা পেছন দিক দিয়ে দেয়া হবে। এমতাবস্থায় তারা মৃত্যুকে ডাকবে, কিন্তু মৃত্যু তো আর হবে না, জ্বলন্ত আগুনই হবে তাদের ঠিকানা। তাদের এমন পরিণতির কারণ হলো কিয়ামত সংঘটন ও আখেরাতে জবাবদিহিতার সেই দিনের কথা তারা বিশ্বাস করতো না। খাও দাও ফুর্তি করো এই নীতিতে তারা ডুবে ছিল এবং পরিবারের নানা ধরণের পার্টি-নাচ-গান অশ্লীলতা ও অপব্যয়-অপচয়ে মগ্ন হয়ে থাকতো এবং দুনিয়ার মজা লুটার জন্য যা করা দরকার তাই করতো। এরপর আল্লাহপাক কসম খেয়েছেন এবং শ্রোতৃমণ্ডলী যাতে তাঁর কথার গুরুত্ব অনূভব করে, সে জন্যই তাঁর কসম খাওয়া। এখানে কসম খেয়েছেন সূর্য ডুবে যাবার পর পশ্চিমাকাশে লাল আভা দেখা দেয়া, দিনের পর রাতের আগমন এবং সময়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর নিজ ডেরায় ফিরে আসা; আবার একফালি চাঁদের ক্রমান্বয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। প্রাকৃতিক এই নিয়মের মত মানুষও তার কর্মজীবন শেষে মৃত্যু, ততপর কবরের জীবন এবং সেখান থেকে উত্থাপিত হওয়া সবই পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকবে। আল্লাহ তা’য়ালার জিজ্ঞাসা-এ অবস্থা জানার পরও কেন তারা ঈমান আনে না এবং তাদের সম্মুখে কুরআন পড়া হলে কেন সিজদাহ করে না (২১ নং সিজদার আয়াত)? বরং কাফিররা উল্টা মিথ্যা আরোপ করে; অথচ আল্লাহর কাছে তাদের ফিরে না এসে উপায় নেই এবং তাদের সকল কর্মকাণ্ড তিনি দেখেন ও জানেন। সেদিন এই অস্বীকারকারীদের ভাগ্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ছাড়া আর কিছুই জুটবে না; পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে ও নেককাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে অফুরান্ত পুরস্কার।
শিক্ষাঃ
কিয়ামতের বর্ণনা ও এর পক্ষে যৌক্তিকতা এবং আল্লাহর আদালতে হিসাবদানের বাধ্যবাধকতা ও আমলনামা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে আখিরাতের বিশ্বাস দৃঢ়মূল করে আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এ সূরাটির উদ্দেশ্য। সমাজে যত অনাচার ও অন্যায়-জুলুম এবং আল্লাহর নাফরমানি সবকিছুর মূলে রয়েছে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসহীনতা। আল্লাহপাক মক্কীযুগের প্রাথমিক অবস্থায় মানুষের মধ্যে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে জীবনযাপনের জন্য এ সব সূরাসমূহ অবতীর্ণ করেন। এখনও মানুসের স্বস্তি-শান্তি-নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হলে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের কোন বিকল্প নেই।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।