শয়তানের পদাঙ্ক পরিহার করে আল্লাহর আনুগত্যই মুক্তির পথ
প্রফেসর ড. মো: আকতার হোসেন
সূরা ইয়াসিন (৬০-৬৮)
অনুবাদ
৬০. হে আদম সন্তান, আমি কি তোমাদের (এ মর্মে) নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের গোলামি করো না, কেননা সে হচ্ছে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।
৬১. (আমি কি তোমাদের একথা বলিনি) তোমরা শুধু আমারই ইবাদত করো, (কেননা) এটিই হচ্ছে সরল সঠিক পথ।
৬২. (আর শয়তান) সেতো তোমাদের মধ্য হতে এক বিরাট সংখ্যক লোককে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছিল, তোমরা কি বুঝতে পারলে না?
৬৩. এ হচ্ছে সেই জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদের সাথে (বার বার) করা হয়েছিল।
৬৪. আজ সবাই মিলে তাতে গিয়ে প্রবেশ করো, যা (দুনিয়ার জীবনে) তোমরা অস্বীকার করেছিলে!
৬৫. আজ আমি তাদের মুখের ওপর সিলমোহর দেবো (আজ) তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে, তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে, এরা কী কাজ করে এসেছে।
৬৬. আমি যদি চাইতাম (দুনিয়ায়) আমি এদের (চোখ থেকে) দৃষ্টিশক্তি বিলোপই করে দিতাম। তেমনটি করলে এরা কিভাবে চলার পথ দেখে নিতো।
৬৭. যদি আমি চাইতাম তাহলে (কুফরির কারণে) তাদেরকে নিজ নিজ স্থানেই তাদের আকৃতি বিনষ্ট করে দিতে পারতাম, সে অবস্থায় এরা সামনের দিকেও যেতে পারতো না, আবার পেছনেও ফিরে আসতে পারতো না।
৬৮. যাতেই আমি দীর্ঘ জীবন দান করি, তাকেই আমি সৃষ্টিগত দিক থেকে তার প্রাথমিক অব্স্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই; এটা দেখেও কি তারাা বুঝতে পারে না (কে তাদের দেহে এ পরিবর্তনগুলো ঘটাচ্ছে)?
নামকরণঃ
সূরাটির প্রথম দু’টি অক্ষর ‘ইয়া-সিন’ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
নাজিলের সময়কালঃ
সূরাটির বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গি বিবেচনা করলে মনে হয় এ সূরাটির নাজিল হওয়ার সময়কাল মক্কি জীবনের মাঝামাঝি পর্যায়ের শেষভাগ অথবা এটা একেবারে শেষ পর্যায়ে নাজিল হওয়া সূরাসমূহের মধ্যে একটি।
আয়াত সমূহের ব্যাখ্যা
৬০ ও ৬১ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা’আলা আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলেন, ‘‘তোমরা আদমের সন্তান হয়ে সেই শয়তানের আনুগত্য করছো যে তোমাদের পিতা আদমকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে জান্নাত থেকে বের করে এনেছিল। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শক্র। তার আনুগত্য ও অনুসরণ না করার জন্য আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। তারপরও তোমরা সেই অভিশপ্ত শয়তানের কথাই মেনে চলছো। শয়তানের আনুগত্য ও অনুসরণের মাধ্যমে তোমরা নিজেদের জন্য জাহান্নামের পথকে বেছে নিচ্ছো। তোমরা যদি সত্য ও সঠিক পথ পেতে চাও তাহলে একমাত্র আমার ইবাদত ও আনুগত্য কর।
আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
‘‘আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কারো গোলামির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।’’ (সূরা জারিয়াত: ৫৬)
‘ইবাদাত’ শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে উবুদিয়্যাত ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবুদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদত’ বুঝানো হয় অলৌকিক , অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে। মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোন সত্তার ‘ইবাদত’ বা উপাসনা করে না। শুধুমাত্র যার মধ্যে অলৌকিক বা অপার্থিব ক্ষমতা আছে, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল বা অমঙ্গল করা বা তা রোধ করার অলৌকিক শক্তি বা অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে বলেই বিশ্বাস করে তারই ‘ইবাদত’ করে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানি (৫০২ হি.) বলেন- ‘‘ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি- অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্মক্ষমতা ও দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এই চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন- তাদেরকে তো কেবলমাত্র এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ ইবাদত করবে এবং সালাত কায়েম করবে এবং জাকাত প্রদান করবে, আর এটাই সঠিক মজবুত দ্বীন। (সূরা বায়্যিনাহ: ৫)
আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতদ্বয়ে ইবাদতকে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাজি তাঁর তাফসিরে কবিরে লিখেছেন- অর্থ তার আনুগত্য করো না। এর দ্বার প্রমাণিত হয় যে, শয়তানকে শুধু সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয়, তার আনুগত্য করা, হুকুম-আদেশ-নিষেধ মেনে নেয়া ও তাঁবেদারি করাও নিষিদ্ধ। অতিএব আনুগত্য ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম রাজি আরও বলেন- ‘‘কোন ব্যক্তি যদি তোমাদের সামনে এসে তোমাকে কোন কাজের হুকুম দেয়, তখন তোমাকে দেখতে হবে তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুরূপ কিনা। অনুরূপ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে মনে করতে হবে তার সাথে শয়তানের যোগ আছে। আর এক্ষেত্রে আর আনুগত্য করার অর্থ হলো শয়তানের ইবাদত করা।
অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহ ইবাদত করেন এবং সাথে সাথে অন্য কারো ইবাদত করেন তাহলে তিনি আল্লাহ ইবাদাতকারী বলে গণ্য হবেন না, কারণ তিনি ইবাদাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক বা অংশীদার করেছেন এবং শিরকে লিপ্ত হয়েছেন। আল্লাহর ইবাদাতের অর্থ বিশুদ্ধভাবে একনিষ্ঠভাবে বা শিরকের কলুষতা থেকে মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং কোন প্রকার ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো্ জন্য না করা। কুরআন কারিমে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন বিশুদ্ধভাবে ইবাদাত করতে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করতে। আল্লাহর বাণী- ‘‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক বানিও না।’’ (সূরা নিসা: ৩৬)
অন্যত্র বলা হয়েছে-
আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি। (সূরা নাহল: ৩৬)
এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাতদ বর্জন করা বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘‘যারা তাগুতের ইবাদত বর্জন করে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয় তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।’’ (সূরা জুমার: ১৭)
কুরআনের পরিভাষায় তাগুত অর্থ শয়তান। এছাড়া আল্লাহকে ছাড়া যা কিছুর ইবাদত, পূজা বা উপাসনা করা হয় তাকে ‘তাগুত’ বলে।
৬২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
উক্ত আয়াতে বনি আদমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘‘যদি তোমাদের জ্ঞান বুদ্ধি হতে বঞ্চিত করে রাখা হতো এবং তারপরে রবকে বাদ দিয়ে শয়তান তথা তাগুতের বন্দেগি করতে, তাহলে তোমাদের পক্ষে ওজর আপত্তি পেশ করার কোন না কোন অবকাশ অবশ্যই থাকতো। কিন্তু তোমাদের নিকট তা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি বর্তমান ছিল এবং এর সাহায্যে তোমরা দুনিয়াবি সকল প্রকার কর্ম সম্পাদন করছিলে। উপরন্তু আল্লাহ তাআয়া তাঁর নবী ও রাসূল প্রেরণ করে অধিকতর সাবধান ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আল্লাহর বাণী-
‘এসব রাসূলকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল, যাতে রাসূলগণকে পাঠানোর পর মানুষের কাছে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে। আল্লাহ অবশ্যই শক্তিমান ও অতিশয় জ্ঞান বুদ্ধির অধিকারী। (সূরা নিসা:১৬৫)
জ্ঞানবুদ্ধিদান ও রাসূল প্রেরণের পরেও যখন তোমরা তোমাদের দুশমনদের ধোঁকায় পড়ে গেলে এবং তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হলো। তখন তোমরা নিজেদের এ বোকামির দায়িত্ব হতে কখনই মুক্ত হতে পারো না।
৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
শয়তানের আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে কুফরি করার কারণে মৃত্যুর পরে তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। যার ভয় দনিয়াতে তাদেরকে দেখানো হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন-
‘নিশ্চয়ই জাহান্নাম একটা গোপন ফাঁদ। বিদ্রোহীদের আবাস। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে। যেখানে তারা গরম পানি ও পুঁজ ছাড়া কোনো রকম ঠান্ডা ও পান করার মতো কোনো কিছুর স্বাদই পাবে না। এটা তাদের পরিপূর্ণ বদলা। (সূরা নাবা: ২১-২৬)
৬৫ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
সে সকল পাপী ও অপরাধী আল্লাহর সামনে তাদের নিজেদের অপরাধ অস্বীকার করবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করার পরও মিথ্যা বলে অভিহিত করবে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের মুখ বন্ধ করে দিবেন। প্রতিটি অঙ্গ পৃথক পৃথকভাবে নিজ প্রভুর সামনে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।
এ আয়াতে তাদের চক্ষু, কান, মুখের জিহবা তাদের কৃতকর্মের বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করবে। যেমন-
সেদিন তাদের মুখ, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। (সূরা নূর: ৪২) অন্যত্র বলা হয়েছে-
এমনকি তারা যখন তার নিকট উপস্থিত হবে, তাদের কান, তাদের চক্ষু এবং তাদের চামড়াও তাদের কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। (সূরা হা-মিম আস সাজদা: ২০)
৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
কিয়ামতের দৃশ্য উপস্থিত করার পর এখন তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই কিয়ামত তো তোমাদের অনেক দূরবর্তী জিনিস বলে মনে করো। কিন্তু একটু লক্ষ্য করে দেখ, এই দুনিয়ার জীবনে যে জন্য তোমরা গর্ব অহঙ্কারে ফেটে পড়ছো- তোমরা অত্যন্ত করুণভাবে আল্লাহর দরবারে তার কুদরতের অধীনে অসহায় হয়ে রয়েছো। যে চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি দ্বারা তোমরা দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম করছো, আল্লাহর ইশারা পেলেই তা অন্ধ হয়ে যেত। যে গায়ের জোরে তোমরা চলাফেরা করছো আল্লাহর নির্দেশে তা সহসা চূর্ণ হতে ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। আল্লাহর দেয়া এ শক্তিগুলো যতদিন কাজ করতে থাকে, ততদিন তোমরা নিজেদের অহমিকায় দিশেহারা হয়ে থাকো। কিন্তু এদের একটি শক্তিও যদি অকর্মণ্য হয়ে যায় তখন তোমাদের ক্ষমতা যে কত তা তোমরা স্পষ্ট বুঝতে পার।
৬৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
এ আয়াতের মর্ম হলো এই যে, আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধকালে মানুষের অবস্থা শিশুদের মতো করে দেন। শিশুদের মতোই তারা চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে থাকে, তাদেরই মত অন্যরা তাদেরকে ওঠায়, বসায় ও হাত ধরিয়ে চলায়। তেমনভাবে অন্যরা তাদেরকে খাইয়ে দেয়, পান করায়। তেমনই তারা নিজেদের কাপড়ে ও বিছানায় পেশাব-পায়খানা করে দেয়। তেমনি অবুখের মতো কথাবার্তা বলতে থাকে, যা শুনে লোকেরা হাসে। এককথায় যেরূপ দুর্বল অবস্থায় মানুষ দুনিয়াতে জীবন শুরু করে, জীবনের শেষভাগে মানুষ ঠিক সেই অবস্থার মধ্যেই পড়ে যায়।
উপরোক্ত আয়াতসমুহের মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ঠ যে, আদম সন্তান দুনিয়ায় একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাতদ ও আনুগত্য করবে না। শয়তান তথা কোনো তাগুত বা খোদাদ্রোহী শক্তির আনুগত্য করা সম্পূর্ণ হারাম। কুফরির কারণে কিয়ামতের দিন তথা পরকালে ভয়াবহ শাস্তির পরিণাম ভোগ করতে হবে। মানুষের মানবিক দুর্বলতা তথা অক্ষমতার বিষয়টিও এখানে ফুটে উঠেছে। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মধ্যেই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত।
লেখক: শিক্ষাবিদও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা’আলা আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলেন, ‘‘তোমরা আদমের সন্তান হয়ে সেই শয়তানের আনুগত্য করছো যে তোমাদের পিতা আদমকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে জান্নাত থেকে বের করে এনেছিল। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শক্র। তার আনুগত্য ও অনুসরণ না করার জন্য আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। তারপরও তোমরা সেই অভিশপ্ত শয়তানের কথাই মেনে চলছো। শয়তানের আনুগত্য ও অনুসরণের মাধ্যমে তোমরা নিজেদের জন্য জাহান্নামের পথকে বেছে নিচ্ছো। তোমরা যদি সত্য ও সঠিক পথ পেতে চাও তাহলে একমাত্র আমার ইবাদত ও আনুগত্য কর।
আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
‘‘আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কারো গোলামির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।’’ (সূরা জারিয়াত: ৫৬)
‘ইবাদাত’ শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে উবুদিয়্যাত ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবুদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদত’ বুঝানো হয় অলৌকিক , অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে। মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোন সত্তার ‘ইবাদত’ বা উপাসনা করে না। শুধুমাত্র যার মধ্যে অলৌকিক বা অপার্থিব ক্ষমতা আছে, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল বা অমঙ্গল করা বা তা রোধ করার অলৌকিক শক্তি বা অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে বলেই বিশ্বাস করে তারই ‘ইবাদত’ করে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানি (৫০২ হি.) বলেন- ‘‘ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি- অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্মক্ষমতা ও দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এই চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন- তাদেরকে তো কেবলমাত্র এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ ইবাদত করবে এবং সালাত কায়েম করবে এবং জাকাত প্রদান করবে, আর এটাই সঠিক মজবুত দ্বীন। (সূরা বায়্যিনাহ: ৫)
আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতদ্বয়ে ইবাদতকে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাজি তাঁর তাফসিরে কবিরে লিখেছেন- অর্থ তার আনুগত্য করো না। এর দ্বার প্রমাণিত হয় যে, শয়তানকে শুধু সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয়, তার আনুগত্য করা, হুকুম-আদেশ-নিষেধ মেনে নেয়া ও তাঁবেদারি করাও নিষিদ্ধ। অতিএব আনুগত্য ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম রাজি আরও বলেন- ‘‘কোন ব্যক্তি যদি তোমাদের সামনে এসে তোমাকে কোন কাজের হুকুম দেয়, তখন তোমাকে দেখতে হবে তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুরূপ কিনা। অনুরূপ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে মনে করতে হবে তার সাথে শয়তানের যোগ আছে। আর এক্ষেত্রে আর আনুগত্য করার অর্থ হলো শয়তানের ইবাদত করা।
অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহ ইবাদত করেন এবং সাথে সাথে অন্য কারো ইবাদত করেন তাহলে তিনি আল্লাহ ইবাদাতকারী বলে গণ্য হবেন না, কারণ তিনি ইবাদাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক বা অংশীদার করেছেন এবং শিরকে লিপ্ত হয়েছেন। আল্লাহর ইবাদাতের অর্থ বিশুদ্ধভাবে একনিষ্ঠভাবে বা শিরকের কলুষতা থেকে মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং কোন প্রকার ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো্ জন্য না করা। কুরআন কারিমে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন বিশুদ্ধভাবে ইবাদাত করতে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করতে। আল্লাহর বাণী- ‘‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক বানিও না।’’ (সূরা নিসা: ৩৬)
অন্যত্র বলা হয়েছে-
আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি। (সূরা নাহল: ৩৬)
এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাতদ বর্জন করা বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘‘যারা তাগুতের ইবাদত বর্জন করে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয় তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।’’ (সূরা জুমার: ১৭)
কুরআনের পরিভাষায় তাগুত অর্থ শয়তান। এছাড়া আল্লাহকে ছাড়া যা কিছুর ইবাদত, পূজা বা উপাসনা করা হয় তাকে ‘তাগুত’ বলে।
৬২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
উক্ত আয়াতে বনি আদমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘‘যদি তোমাদের জ্ঞান বুদ্ধি হতে বঞ্চিত করে রাখা হতো এবং তারপরে রবকে বাদ দিয়ে শয়তান তথা তাগুতের বন্দেগি করতে, তাহলে তোমাদের পক্ষে ওজর আপত্তি পেশ করার কোন না কোন অবকাশ অবশ্যই থাকতো। কিন্তু তোমাদের নিকট তা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি বর্তমান ছিল এবং এর সাহায্যে তোমরা দুনিয়াবি সকল প্রকার কর্ম সম্পাদন করছিলে। উপরন্তু আল্লাহ তাআয়া তাঁর নবী ও রাসূল প্রেরণ করে অধিকতর সাবধান ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আল্লাহর বাণী-
‘এসব রাসূলকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল, যাতে রাসূলগণকে পাঠানোর পর মানুষের কাছে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে। আল্লাহ অবশ্যই শক্তিমান ও অতিশয় জ্ঞান বুদ্ধির অধিকারী। (সূরা নিসা:১৬৫)
জ্ঞানবুদ্ধিদান ও রাসূল প্রেরণের পরেও যখন তোমরা তোমাদের দুশমনদের ধোঁকায় পড়ে গেলে এবং তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হলো। তখন তোমরা নিজেদের এ বোকামির দায়িত্ব হতে কখনই মুক্ত হতে পারো না।
৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
শয়তানের আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে কুফরি করার কারণে মৃত্যুর পরে তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। যার ভয় দনিয়াতে তাদেরকে দেখানো হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন-
‘নিশ্চয়ই জাহান্নাম একটা গোপন ফাঁদ। বিদ্রোহীদের আবাস। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে। যেখানে তারা গরম পানি ও পুঁজ ছাড়া কোনো রকম ঠান্ডা ও পান করার মতো কোনো কিছুর স্বাদই পাবে না। এটা তাদের পরিপূর্ণ বদলা। (সূরা নাবা: ২১-২৬)
৬৫ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
সে সকল পাপী ও অপরাধী আল্লাহর সামনে তাদের নিজেদের অপরাধ অস্বীকার করবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করার পরও মিথ্যা বলে অভিহিত করবে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের মুখ বন্ধ করে দিবেন। প্রতিটি অঙ্গ পৃথক পৃথকভাবে নিজ প্রভুর সামনে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।
এ আয়াতে তাদের চক্ষু, কান, মুখের জিহবা তাদের কৃতকর্মের বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করবে। যেমন-
সেদিন তাদের মুখ, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। (সূরা নূর: ৪২) অন্যত্র বলা হয়েছে-
এমনকি তারা যখন তার নিকট উপস্থিত হবে, তাদের কান, তাদের চক্ষু এবং তাদের চামড়াও তাদের কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। (সূরা হা-মিম আস সাজদা: ২০)
৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
কিয়ামতের দৃশ্য উপস্থিত করার পর এখন তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই কিয়ামত তো তোমাদের অনেক দূরবর্তী জিনিস বলে মনে করো। কিন্তু একটু লক্ষ্য করে দেখ, এই দুনিয়ার জীবনে যে জন্য তোমরা গর্ব অহঙ্কারে ফেটে পড়ছো- তোমরা অত্যন্ত করুণভাবে আল্লাহর দরবারে তার কুদরতের অধীনে অসহায় হয়ে রয়েছো। যে চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি দ্বারা তোমরা দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম করছো, আল্লাহর ইশারা পেলেই তা অন্ধ হয়ে যেত। যে গায়ের জোরে তোমরা চলাফেরা করছো আল্লাহর নির্দেশে তা সহসা চূর্ণ হতে ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। আল্লাহর দেয়া এ শক্তিগুলো যতদিন কাজ করতে থাকে, ততদিন তোমরা নিজেদের অহমিকায় দিশেহারা হয়ে থাকো। কিন্তু এদের একটি শক্তিও যদি অকর্মণ্য হয়ে যায় তখন তোমাদের ক্ষমতা যে কত তা তোমরা স্পষ্ট বুঝতে পার।
৬৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা:
এ আয়াতের মর্ম হলো এই যে, আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধকালে মানুষের অবস্থা শিশুদের মতো করে দেন। শিশুদের মতোই তারা চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে থাকে, তাদেরই মত অন্যরা তাদেরকে ওঠায়, বসায় ও হাত ধরিয়ে চলায়। তেমনভাবে অন্যরা তাদেরকে খাইয়ে দেয়, পান করায়। তেমনই তারা নিজেদের কাপড়ে ও বিছানায় পেশাব-পায়খানা করে দেয়। তেমনি অবুখের মতো কথাবার্তা বলতে থাকে, যা শুনে লোকেরা হাসে। এককথায় যেরূপ দুর্বল অবস্থায় মানুষ দুনিয়াতে জীবন শুরু করে, জীবনের শেষভাগে মানুষ ঠিক সেই অবস্থার মধ্যেই পড়ে যায়।
উপরোক্ত আয়াতসমুহের মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ঠ যে, আদম সন্তান দুনিয়ায় একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাতদ ও আনুগত্য করবে না। শয়তান তথা কোনো তাগুত বা খোদাদ্রোহী শক্তির আনুগত্য করা সম্পূর্ণ হারাম। কুফরির কারণে কিয়ামতের দিন তথা পরকালে ভয়াবহ শাস্তির পরিণাম ভোগ করতে হবে। মানুষের মানবিক দুর্বলতা তথা অক্ষমতার বিষয়টিও এখানে ফুটে উঠেছে। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মধ্যেই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত।
লেখক: শিক্ষাবিদও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
[টাইপে কোনো ভুল পরিলক্ষিত হলে কমেন্টে অথবা ronobaddo@gmail.com এ জানান]