স্মৃতিতে আমাদের আল্লামা -মানছুরা আল আজাদ

 

স্মৃতিতে আমাদের আল্লামা
-মানছুরা আল আজাদ

সালটা দুই হাজার ছয়!
ছোট্ট মন ও মানুষ,
কিছু বুঝে উঠেছি কিছু বুঝে উঠার মতো বুঝশক্তি তখনো হয়নি।
কোন এক বেলায় খেলার ফাঁকে আম্মু আমাদেরকে বললেন দু'দিন বাদে ঢাকায় যেতে হবে,
সম্মেলন আছেন তাদের।
আমরাও বেশ খুশি,প্রথমবারের মতো এতদূর ঢাকায় যাবো।
সবমিলে ৩ দিনের প্রস্তুতিসহ রওনা হলাম আব্বু,আম্মু ভাইয়া আর আমি,
সাথে জেলা থেকে আরও অনেক দায়িত্বশীলরা।
সারা রাস্তা তো হরেক রকম নিত্য নতুন জায়গা দেখা,পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে পৌঁছে গেলাম ঢাকায়,
বাস কাউন্টার থেকে নেমে পল্টনের উদ্দেশ্যে গাড়ীতে উঠে যাওয়ার পথে অসংখ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ও আশ্বাস গুলো এখনো চোখে ভাসে,
কি বিপ্লবী দিন ছিলো আমাদের!
এরপরে যখন পল্টনে পা দিলাম সেতো এক জনসমুদ্রের ধারা যেন বহমিত স্রোতের ন্যায় ভরপুর।
ছোট্ট জীবনে প্রথম এত হাজার হাজার মানুষ দেখে কিছুটা ভয় ও উল্লাসের অনুভূতি যেন।
প্যান্ডেলের ভিতরে প্রবেশের পরে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি,নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে জায়গা করে দেওয়া,অজুর পানি ঢেলে দেওয়া,খাবারের বাটি টা অন্যকে আগে দেওয়া,প্রাথমিক ঔষধ কিবা প্রয়োজনীয় প্রয়োজনগুলোর দিকে খেয়াল রাখার মাধ্যমে যেন এক পারস্পরিক আন্তরিকতার সবটুকু উজাড় করার অনুভূতি দেখেছি সেদিন।
এত হাজার হাজার মানুষের জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের যে অক্লান্ত ও আন্তরিক সহযোগিতা ছিলো তা ছোট্ট হৃদয়েই দাগ কেটে গিয়েছিলো।
মূল প্রোগ্রাম শুরু হলো একে একে দায়িত্বশীল চাচারা বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন,চারদিকে সবার পিনপতন নিরবতাও শুরু হলো শুধু মাইকের কণ্ঠস্বর টি ছাড়া।
এরইমধ্যে প্যান্ডেলের এপারে থাকা আমার দূরন্তপনা মনের কৌতূহল জাগলো কোথা থেকে এই মাইকের আওয়াজ আসছে তা দেখার জন্য!
সাথেসাথে আম্মুকে না বলে ছোট মানুষ দৌঁড়াতে লাগলাম সামনের দিকে,
মহিলা প্যান্ডেল ভেদ করে পুরুষ প্যান্ডেলের দিকে গিয়ে মঞ্চের বরাবর ছুটতে লাগলাম,
এক পর্যায়ে চলেও গেলাম মঞ্চের কাছাকাছি।
গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই একটি নাম ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই চারদিকে তাকবির আর শুভেচ্ছার শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো।
নামটি তার আগেও শুনেছি,ক্যাসেটে ওয়াজ শুনেছি,কিন্তু সেদিনের মতো করে বুঝে উঠতে পারি নি যে তিনি অনেক বড় একজন কেউ,বা তার ভক্ত অনুকূল এত এত মানুষ।
এরপর শুরু হলো নাহমাদূহু নুসাল্লিহ আলা....বলে এক দারাজ কণ্ঠের উচ্চারণ,
কেঁপে উঠলো সবগুলো মাইকের আওয়াজ,চারদিকে হাজার হাজার চাতক পাখির মতো টরটর করে তাকিয়ে থাকা চোখ।
একে একে আল্লাহর প্রশংসা,রাসূলের প্রতি দরুদ শেষ করে মূল বক্তব্য,উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে নসিহত,ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জযবার অন্যতম নজরানা পেশের জন্য প্রস্তুত হওয়া থেকে আরও অনেক অনেক সুমধুর উচ্চারণের মাধ্যমে শেষ করলেন তার বক্তব্য।
আমি তখন মঞ্চের নিচে একদম সামনে ছোট্র একটা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম একাকী,
কোন ভয় কিবা হারানোর চিন্তা ছিলো না আমার সে মনে।
কিছু শব্দ তখন বুঝেছে আর কিছু হয়তো বুঝে উঠতে পারিনি।
তবে এটুকু বুঝেছিলাম পরিবার থেকে যে ইসলাম দেখে ও শুনে এসেছি,যে বড় নেতাতের গুণাবলীর কথা শুনেছি সে নেতা মনে হয় এই ব্যক্তিই।
উনার বক্তব্যের পরে অনন্য নেতাদের বক্তব্য শেষে আমি তখনও সে মঞ্চে পাশে দাঁড়িয়ে,ওপাশে আম্মু,এপাশে আব্বু ও স্বেচ্ছাসেবীরা আমাকে খুঁজছে,এক পর্যায়ে না খুঁজে পেয়ে মাইকে এলার্ম হলো এক ছোট্ট মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
তখন কিছুটা ভয় পেলেও একটু পরেই দেখি মঞ্চ থেকে এক জন নেমে এসে আমাকে মঞ্চে উঠায়ে নিয়ে গেলেন,গিয়ে ওখানে নিজের নাম,পরিচয় জিজ্ঞেস করার পরপর কিছুক্ষণের মধ্যে আব্বু এসে আমাকে নিয়ে গেলেন।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে,মঞ্চে থাকাকালীন সে সময় টুকু আমি শুধু এক মেহেদী রঙিন চেহারার দিকেই তাকাচ্ছিলাম বারবার,
কি শুভ্র,সফেদ তরতাজা একটি প্রাণ!
মন খোলা তার হাসি,বাকপটু তার কথা,বগ্নিতার ভাষা।
এরপরে আর কখনো সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি,বগুড়ায় তার শেষ সম্মেলন ছিলো নয় সালে।
বিয়ের পর আমার শ্বাশুড়ি মা যতবার আমীরে জামায়াত চাচা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় যে চাচা'ই বাসায় আসতেন ততবারই তিনি সে একটি নামের কথা বলতেন,
উচ্চারণ করতেন আফসোস ও আশা নিয়ে,যে উনি মা'র হাতের কোন কোন রান্না পছন্দ করতেন ও কি কি দুয়া করতেন!
সে ব্যক্তিকে আবারও নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানোর মনোবাসনা তার রান্না ঘরের দেয়াল গুলো শুনে শুনে চিরপরিচিত হয়েছে বুঝি!
এইতো গত মাসে যখন ভিতরের জন্য খাবারের বাটি সাজানো হচ্ছিলো তখন লাউ দিয়ে আইড় মাছের যে ঝোল সে বাটির উপরে তার বারবার হাত বুলিয়ে চাচার জন্য দুয়া ও আশার প্রতিচ্ছবি ছিলো স্পষ্ট,
হয়তো ভেবেছিলেন ক'দিন বাদে এই জুলুমের অবসান হলে নিজ হাতেই প্লেটে বাড়িয়ে খাওয়াবেন।
তা আর হলো না!
তিনি চলে গেলেন ওপারে অনিন্দ্য এক ভূবনে,
রেখে গেলেন স্মৃতি,আশা ভরসা আর হাজারো দুয়ার হাতগুলো।
এপারের সব শূন্যতা জমে জমে ওপারে সালসাবিলের বহমিত পাড়ে আমাদের আবার এক মহাসম্মেলন হবে,
মোহাব্বতের হৃদয় গুলো একত্রিত হবে সেদিন।
যেখানে সে দারাজ কণ্ঠে বেঁজে উঠবে নাহমাদূহু নুসাল্লিহ আলা...
আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন,
আমাদেরকে হারানো সম্পদের যথাযথ হক্ব আদায়ের তৌফিক দান করুন,
আপনার পরিকল্পিত কুরআনের রাজ এ জমিনে প্রতিষ্ঠিত করুন।
(আমীন)
আমাদের নেতা!আমাদের সম্পদ,আমাদের আল্লামা,আমাদের রাহবার..

Post a Comment

Previous Post Next Post